সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

 আমার স্বামী ভুরু কুঁচকে শক্ত গলায় আচমকা বলে উঠল,

"শেলী, সকালে মাকে কি তুমি বাসি রুটি খেতে দিয়েছ?"
আমি সদ্য অফিস থেকে ফিরেছি।আচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে যখন জলের তেষ্টায় ফ্রিজ খুলতে গেলাম তখনই বসার ঘর থেকে বেশ উচ্চস্বরে আদিত্য এমন প্রশ্ন করল।
আমার জলের তেষ্টা যেন মুহূর্তেই শেষ। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আমার শ্বাশুড়ি জপের মালা হাতে বেলকুনিতে বসা। মুখের অবয়বে এমন ভাব যেন ইহকাল সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ নেই।
আমি উত্তর দেবার কোন আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না। জলের সঙ্গে নিজের অনেক কথা গিলে ফেলে নিজের ঘরে পা বাড়াতেই আদিত্যের চিৎকার কানে এলো।
"কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ এড়িয়ে চলা আজকাল তোমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। কাজের মানুষ একদিন নেই ।তাই তুমি যা ইচ্ছা করছো।ডায়বেটিকস রোগীকেও তোমার অলসতার স্বীকার না বানালে নয়।"
এবার ঘুরে দাড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে বললাম, "কালকে রুটি কোথায় ছিলো যে আজ বাসি রুটি দেবো?"
আদিত্য এবার বেশ দমে গিয়ে বলল,
"আটার গোলা তো ছিল ? তা থেকে রুটি বানিয়ে কেন মাকে দিলে? তুমি জানো না মা ফ্রিজের কিছু খায় না।"
আমি হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলাম। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করা হল।আমি লাউড স্পিকার দিতেই শোনা গেল,
"দিদি কেমন আছো গো? কাল ঠিক সকালে আসবো। আমি তো সমস্যায় না পরলে কাজে কামাই দেই না.........."
আমি কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম,
"রুটির গোলা ফ্রিজে কয়টা ছিল?"
আমার কাজের দিদি দ্রুত বলল,
"তিনটাগো দিদি ।কেনো কি হয়েছে?"
আমি আর কথা বাড়ালাম না,
"ঠিক আছে ,কাল এসো।" বলেই লাইন কেটে দিলাম।
আদিত্যের চোখে চোখ রেখে বললাম,
"তুমি দুটো ,আর আমি একটি সকালে একসাথে খেলাম। এরপর তো বাবু উঠলে আবার রুটি বানালাম ।তুমি তো সামনেই চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলে ।দেখ নি?এরপর আশাকরি আর কোন কথা নেই।"
প্রচুর বিরক্তিতে নিজের ঘরে দিকে পা বাড়ালাম। আমি আলনাতে গোছানো বাসার পরার কাপড় নিতে নিতে শুনতে পেলাম,
আদিত্য চিৎকার করে তার মাকে বলছে,
"সত্যি বল তুমি। শেলী দিন দিন বুদ্ধিহীন বেয়ারা হচ্ছে। বললেই হত, না আমি বাসি রুটি দেই নি। পরে আবার তোমার সামনে বাবু মায়ের জন্য রুটি বানিয়েছি। তা নয় একটা কাজের লোককেও জানাতে হয় ঘরের কথা। কি করে যে সংসার করছি তা আমিই জানি।"
আমার ঠোঁটে উপক্ষার হাসি ছিটকে বেড়ুলো। আড়চোখে চেয়ে দেখলাম আমার একমাত্র ছেলে দীপ্ত ঘুমাচ্ছে। ভাগ্যিস বাবার চিৎকার চেঁচামেচি তার কানে যাচ্ছে না।কি যে অদ্ভূত পরিবেশে তাকে বড় করছি । অন্যদের তো কেবল কলহ পছন্দ।
আমি স্নান ঘরে গেলাম। স্নানঘরটাই আজকাল আমার সবচেয়ে শান্তির যায়গা হয়ে উঠেছে। কত দুঃখ ,কষ্ট,উপেক্ষার গল্প জলের ধারাবাহিকতায় ধুঁয়ে মুছে পরিস্কার করে যে নেই ,তা কেবল আমিই জানি।
বারো বছরের সংসার জীবনে বারো দিনও যেখানে কোন সম্মান পেলাম না , আমাকে বিশ্বাসটুকু যখন আমার স্বামী করে না ,এমন জায়গায় নির্জন আর শান্তির স্হান কেবল স্নানঘরকে বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
স্নান করে পূজা শেষে দেখলাম আমার দশ বছরের ছেলে নড়েচড়ে উঠে পরেছে। আমি অফিস থেকে আসলে তার অনেক গল্প থাকে স্কুল ,টিচার,খেলার মাঠ, ড্রইং ক্লাস সব মিলিয়ে আমার সন্ধ্যা কাটে ছেলের সাথেই।এরপর রান্নায় রান্নায় রাত বেড়ে বারোটায় গিয়ে শেষ হয়।
আমি দীপ্তকে নাস্তা দিয়ে আদিত্যকে চা দিতেই সে কাপটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বাইরের কাপড় পরে বেরিয়ে গেল সজোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে।আমি নিজের চায়ের সাথে আদিত্যের চা টুকু শেষ করলাম। মনটা যতই ভাড়ি হোক শরীরটাকে হালকা রাখা দরকার।আর আদিত্যের আচরনকে ভোলার চেষ্টা করলাম।
কারণ , পুরুষ মানুষকে হয়তো যতই যুক্তি দিয়ে বোঝাও না কেনো ঘরের বৌয়ের কাছে পৌশাচিক রূপের পরিচয় না দিলে তারা নিজেদের পরিপূর্ন স্বামী হিসেবে গন্য করতে পারে না।তাই অযথা চিন্তা করে লাভ নেই।
আমি শ্বাশুড়ির ঘরে চা দিতে গেলাম। অনেক কষ্টে সে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে ট্রে সমেত চা বিছানায় রাখল।আস্তে আস্তে বলতে লাগল,
"তুমি এমন করলে তো আমার ছেলে একদিন রাগতে রাগতে স্ট্রোক করে মারা যাবে।"
আমি সচারচর আমার শ্বাশুরির সাথে কথা বলি না। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি । কিন্তু আজ বললাম,
"বাঁতের ব্যাথা কমেছে আপনার ?"
শ্বাশুড়ি আড়মোড়া দিতে দিতে বললেন,
"না কই আর কমলো? কি ডাক্তার দেখাও বুঝিনা বাপু। ব্যথায় তো জীবন শেষ।"
এবার বেশ শক্ত চোয়ালে বললাম, "আপনিতো সকালেও ব্যাথায় কাতড়াচ্ছিলেন। অফিস যাওয়ার আগেও তো দেখলাম শুয়ে আছেন।"
শ্বাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, "কি করব বল? জীবনেতো কষ্ট কম করিনি?তবে সংসারে সুখ আর পেলাম কোথায়?"
একটু গলা কেশে বললাম,
"অযথা কথাগুলো না বললেই তো সংসারে সুখ থাকতো।শুয়ে শুয়ে অশুভ স্বপ্ন দেখলে কি সংসারে সুখ আসে ?"
আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে শ্বাশুড়ি বললেন,
"আজ আসুক আদি তোমার আজ হচ্ছে।"
আমি হেসে বললাম,
"মা হয়েই সন্তানের আয়ু যে কমাতে ব্যস্ত, তার সন্তানকে করুনা না করলেও চলবে।"
আমি রুম থেকে বেড়ুতেই অজস্র অভিশাপ আমাকে দিয়ে একসময় শান্ত হলেন তিনি।ভেবেছিলাম আবার সংসারে ঝড় উঠবে। কিন্তু আদিত্য বাইরে থেকে
আসলেও সব গম্ভীর হলেও ঝড় আর উঠল না।
আমি শেলী মজুমদার। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন। আদরে বড় হয়েছি কেবল তা নয়, পড়াশুনাতেও ভাইদের সমান ছিলাম। মাষ্টার্স পাশ করেই লাইব্রিয়ান হিসেবে চাকরি পেয়েছি অনায়াসে। এরপর আদিত্য এলো আমার জীবনে । সরকারি কলেজের প্রভাষক । বাবা মায়ের মেঝো ছেলে ।দেখতেও ভালো।সংসারে কেবল মা। তিন ভাইয়ের কর্মস্হল ভিন্ন। সব মিলিয়ে বিয়েটাও বেশ ধুমধাম করে হয়ে গেল।
বিয়ের প্রথম কয়েকদিন দিন অনায়াসেই কাটল। এক সকালে অফিসে যাবার জন্য যখন রেডি হচ্ছি, তখন আদিত্য খাবার টেবিলে চেঁচিয়ে বলছে ,
"একটু জল দাও তো।"
আমিও রেডি হতে হতে বললাম,
"তুমি একটু নিয়ে নাও। দেরী হচ্ছে তো আমার।"
আমি জানতাম না এ কথাটার ওজন কতটুকু ছিল। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি হুড়হুড় করে ঘরে ঢুকেই যাচ্ছে তাই বলা শুরু করল।যার একমাত্র সারমর্ম:
"স্বামী এমন এক পূজনীয় ব্যক্তি যে নিজের হাতে জল খেলেও আমি নরকে চলে যাবো।"
সব কথা ঠান্ডা মাথায় শুনে আমিও বোঝালাম ,স্বামীতো পঙ্গু নয়,অথর্ব নয়। তাহলে কেনো সে এতটুকু কাজ করতে পারবে না। আর সহযোগীতা ছাড়া দুজন মানুষ সংসার কিভাবে করবো?
সেদিন আমার এই ভুলে আমার অফিস যাওয়া না হলেও । শ্বশুরবাড়িতে মুখরা,শিক্ষিত বেশী বোঝা বউ, সংসারের অশান্তির একমাত্র কারণ হিসেবে উপসংহারে পৌছে গেলেন আমার শ্বাশুড়ি ।আদিত্য উল্টো মায়ের কথাকে সায় দিয়ে আমাকেই বোঝাতে লাগলো।
এখানেই থেমে থাকেনি আমার শ্বাশুড়ী এই কথা পৌছে দিল আমার বাবার বাড়ি। তবে আরও আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন বাবার বাড়িতে আমি যতই সবাইকে বোঝাই, উল্টো সবাই আমার দোষটাই দেখছে কেনো তর্ক করছি এজন্য।
আমার মা বোঝালেন, বইয়ের বিদ্যা যেন বাস্তবে প্রয়োগ না করি।
বাবা বোঝালেন, স্বামী প্রভু,ভগবান ।সংসার করতে গেলে এ জ্ঞান থাকতে হবে।
ভাইয়েরা অবধি,শ্বশুড়বাড়িতে মা বাবার সম্মান রাখতে বললেন।
যদিও সবার মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন সংসার না ভেঙে যায় তাই আমাকে বোঝানো।কিন্তু আমি মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি ভেঙে পরেছিলাম।
সবচেয়ে কষ্ট লেগেছিল আদিত্যের আচরনে। তার দিন আর রাতের আচরনে এতটাই পার্থক্য ছিল যে আমার নিজের বোঝার ক্ষমতার উপর সন্দেহ হতে লাগল।
রাতের আঁধারে সে বোঝাতো মা যেন ভুল না বোঝে তাই সে আমার সাথে খারাপ আচরন করে ।কামনার অধ্যায় শেষ হতেই ,সূর্যের আলোয় আদিত্যের নোংরা আচরন দিনকে দিন বেড়ে যেতে লাগলো।মাকে খুশি করতে স্ত্রীকে অপমান করতে কেনো হবে? এ ব্যাপারটাই আমার মাথায় ঢুকতো না।
রাতের অন্ধকারে যথার্থ পুরুষকে আবার দিনের আলোতে রং বদলে গিরগিটি হতে দেখে অসম্মানে শারীরিক মানসিক দূরত্ব বাড়া শুরু হলো আমার।
যখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম একা থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।ঠিক তখন আমার দেবরের বিয়ে ঠিক হলো।
বিয়ের ঝামেলার পর শ্বাশুড়ি দেবরের সাথেই থাকতে লাগলেন। এরপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আদিত্যের আচরনের বেশ পরিবর্তন। আমাকেও সাহায্য করছে। ধীরে ধীরে আমাদের দূরত্ব কমতে লাগলো।
কিন্তু তিন মাস পর শুনলাম দেবর বিরক্ত হয়ে শ্বাশুড়িকে বড়দার বাসায় রেখে এসেছে।আমি তারপরও বেশ স্বস্হিতেই ছিলাম।কিন্তু আমার শ্বাশুড়িকে নিয়ে দুই ভাইয়ের সাথে আদিত্যের প্রচুর ঝগড়া হলো। আদিত্য ছটফট করতে লাগলো । আমিও বোঝাতে লাগলাম,
আমার শ্বাশুড়ি নিজের সন্তানকে ধরে রাখতে, সংসারে অশান্তি করছে যা তার মানসিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। কিন্তু দুই ছেলে মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো।এমনি আমাদের সাথেও।
আমার স্বামীর কাছে অন্য দুই ভাই ব্যক্তিত্বহীন তাই বউয়ের কথার প্রাধান্য দিয়েছে। দিনকে দিন আমার স্বামী আবার আগের মত মায়ের আচল ধরা আদর্শ সন্তান হয়ে উঠল।এমন ব্যাক্তিত্বপূর্ন স্বামীকে আবার যখন অসহ্য লাগা শুরু হল,পারিবারিক অশান্তির যখন শেষ পর্যায় ।তখন জানতে পারি আমি সন্তান সম্ভবা।
পেটে সন্তান আসতেই আমি কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কে কি বলছে তার দিকে সমস্ত উপেক্ষা ছিল আমার। কাজের মানুষ রাখলাম সারা বেলার জন্য।
আমার নির্লীপ্ত সংগ্রামী জীবনে দুটো মানুষ আস্তে আস্তে আমার অধ্যায়ের বাইরে যেতে শুরু করল। কিন্তু সন্তান হতেই আমার শ্বাশুড়ি নাতীর মুখ দেখে এতো আদিখ্যেতা শুরু করলেন যেন আমি আমার সন্তানের মা নই। কেবল জন্মদাত্রী। তিনিই যেন কেবল দীপ্তর ভালো মন্দ বোঝেন।
এসবে আমি যতটুকু উপকৃত হলাম তাহলো, আমার সন্তানকে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছেই রেখে অফিস করা যেতো। আদিত্যও বেশ আদর করে নিজের ছেলেকে ।তাই বুঝতে শিখলাম একজন সন্তানকে একা মানুষ করার চেয়ে পরিবারের ভেতর রাখলেই ও আনন্দে বেড়ে উঠতে পারবে।
তবে আস্তে আস্তে আমার মানসিক নির্যাতনের রূপ বদলালো। ঠাকুমা বাবা মিলে আমার ছেলে বড় হতেই আমার নামে যতটুকু কলহ করলে দীপ্ত আমার থেকে দূরে চলে যাবে ততটুকু করতে লাগল ।
ছোট ছোট বিষয়ে মিথ্যে কথা বলা আমার শ্বাশুড়ির স্বভাবে পরিনত হলো। আর সেই মিথ্যার জের ধরে উদ্ধত ও দ্বিমুখী আচরন করা আদিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে লাগলো।
আজকের ঘটনাটাও সে জন্য ঘটানো। কিন্তু দীপ্ত ঘুমানো তাই সে কিছু বুঝলো না। আমিও সাংসারিক অবাঞ্চিত ঘটনাগুলোতে মাঝে মাঝে নতুন করে ভাবতে শিখেছি।আবার একা হবার কথা মাথায় আসে মাঝে মাঝে।
আবার কষ্ট হলেই ভাবি তবুওতো দীপ্তকে রেখে নিশ্চিন্তে চাকরিতো করছি। চাকরি করার জন্য ওর ঠাকুমা ছাড়া অন্য বাইরের লোককে আর বিশ্বাস হয় না। মায়ের বাড়িতে পাঁচ বৌদিদের সংসারে ঝামেলা না করে নিজের সবটা মেনে নেওয়াকেই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হয় আজকাল।
বাবা হিসেবেও আদিত্য নিজের সন্তানকে সব কিছু দিচ্ছে।কেবল এ সংসারে আমি আগাছা এটাই যা সমস্যা।
যাই হোক , যখন রাত বাড়ে পুরুষ মানুষের চেহারাও বদলে যায়।আজও তার অন্যথা হল না।
যেহেতু দিপ্ত ঠাকুমার কাছে ঘুমায় আমরা স্বামী স্ত্রী খুব কাছাকাছি থাকি। একান্তে থাকার সুবিধা এরপর আবার বৃহষ্পতিবার। আদিত্য বেশ কাছাকাছি হতে চাইলো।
আমাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে বলল,
"যা হয়েছে ভুলে যাও। "
আমি এই আদিত্যের সাথে পরিচিত। হাতটি শরীর থেকে সরিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে ঘুমের ভান করে রইলাম।
আদিত্য বেশ জোরে বলে উঠল,
" ঢং না করে কাছে এসো বলছি।"
আমার এখন আর শারীরিক সুখ পেতে মন চায় না। যেখানে মনটাই মরে গেছে সেখানে শরীরের কসরত করে লাভ কি?
আমি চাপা স্বরে বললাম, "পাশের রুমে কথা শোনা যায়। চিল্লিও না।"
আদিত্য আমার হাত খাঁমচে ধরল।আমি হাতটা সরানোর চেষ্টা করতেই বলে উঠল,
"তোমার মত বউয়ের চাইতে রাস্তার খারাপ মেয়েগুলোও ভালো। সেখানে গেলেই এখন ভাল হবে।কেবল তুমি দীপ্তর মা আর লোক লজ্জার ভয়। নচেৎ কবেই তোমাকে জীবন থেকে দূর করে দিতাম।"
আদিত্যের এসব কথায় আমার কিছু যায় আসে না।আগে বলতো, আরেরকটা বিয়ে করবে। যখন নিজেই সম্মতি দিতাম।করলে তো আমারই মুক্তি।তখন দমে যেতো। দীপ্ত হতেই এখন অন্য সুর।
আমি জানি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা যতই বউকে অত্যাচার করে তৃপ্তি পাক না কেনো । বাইরে গিয়ে নোংরা কালীতে হাত অপরিষ্কার করবে না। তাই এসবে কান না দিলেও চলবে।
আমি আদিত্যের চোখে চোখ রেখে হেসে দিলাম। আদিত্য কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।
ঠান্ডা মাথায় বললাম, "ঘুমিয়ে পর।"
বেশ কিছুক্ষন পর নাক ডাকার শব্দ শুনে চিন্তা মুক্ত হলাম। মেয়েরা না পাওয়ার কষ্টে দিনের পর দিন রাত জেগে থাকতে পারলেও ছেলেরা ঘুমের সাথে কখনো আপোষ করে না।
আমার সন্তানের মুখ চেয়েই যখন বেঁচে থাকা তখন আর কষ্ট পেয়ে লাভ নেই।এখন আমিও ঘুমিয়ে পরি সাত পাঁচ না ভেবে।
রবিবার কাজের দিদি আসতেই দীপ্তকে স্কুলে দিতে যাবে এমন সময় দীপ্ত জিদ ধরলো আমাকেই স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে।দিদিটাই স্কুল থেকে দীপ্তকে নিয়ে আসে। কিন্তু আজ যেন দীপ্তর জিদ কমছে না। আমাকেই স্কুল থেকে ওকে আনতে হবে আর কোন কথা সে শুনবে না।
আমি ঠিক করলাম একটু ছুটিরও প্রয়োজন নিজের জন্য । আজ অফিস থেকে আধা বেলার ছুটি নিয়ে আসবো।
কাজ দ্রুত শেষ করে স্কুলে পৌঁছাতে একটু দেরী হয়ে গেল। দীপ্ত স্কুল বেঞ্চে বসে ছিল। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরল।
আমিও আদর করতে লাগলাম। পেছন ফিরে দেখলাম দীপ্তর একজন শিক্ষিকা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে কিছু গোলাপ ফুল আর একটি রেপিং পেপারে মোড়া বেশ বড় বাক্স।
আমি সম্বোধন করে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে লাগলাম।ম্যাডাম বললে " একটু ক্লাস রুমে আসুন । কিছু কথা আছে।"
আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পরলাম। দীপ্তের ব্যাপারে কি কোন সমস্যার কথা বলবে? এমনিতেই সাংসারিক কলহ ,ঝামেলা লেগেই থাকে,সেই সাথে আমার বিরুদ্ধে কত কথা তাকে শুনতে হয়। বুকের ভেতর চিন্তার পাহাড় নিয়ে ম্যাডামের পেছন পেছন গেলাম।
হাতের সব জিনিস বেঞ্চে রাখতে রাখতে ম্যাডাম বললেন,
"আপনার ছেলে সম্পর্কে কিছু বলুন।"
আমি বেশ হতচকিত হয়ে বললাম,
"ম্যাডাম, এমনিতেতো ভালই, রেজাল্টও ভালই করছে দেখি। বাসায়তো বেশ শান্ত । কি হয়েছে ম্যাডাম?"
ম্যাডাম বলেছেন,
"আপনার ছেলে বড় হয়ে অনেক বড় মাপের মানুষ হবে,মিলিয়ে দেখবেন।
আমি তোতলাতে লাগলাম।
ম্যাডাম বললেন ,"কয়েকমাস আগে আমি বলেছিলাম যাকে সবচেয়ে তুমি ভালবাসো তার সম্বন্ধে দশ লাইন লিখ। আপনার ছেলে সেদিন কিছুই লিখেনি।
ক্লাসে বেশ বকেছিলাম আমি। ক্লাস শেষ হতেই আমার কাছে এসে বলল, "আমি মাকে অনেক ভালবাসি। কিন্তু কেবল ভালবাসলে কি হবে? আমি তো তার জন্য কিছুই করতে পারছি না।"
এত ছোট ছেলের চিন্তা ভাবনা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কি করতে চাও তুমি?ছেলে কি করেছে জানেন?"
আমি মাথা নেড়ে জানালাম কোন কিছুই আমার বোধগম্য নয়।
ম্যাডাম গোলাপ আর উপহারের বাক্সটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, "প্রতিদিন টিফিনের টাকা আপনার ছেলে আমায় দিত যেন আমি জমিয়ে রাখতে পারি। আর জমানো টাকা দিয়ে আপনার ছেলের কথামত আজ এই উপহার কিনে আনলাম।"
আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।দশ বছরের একটি ছেলে যে তার মাকে এভাবে উপহার দিতে পারে তা ধারনাই ছিলনা আমার।শিক্ষিকাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব আমার ভাষা ছিল না।
ম্যাডাম বললেন,"আমি এই স্কুলে অনেক পুরাতন শিক্ষিকা।তবে আমার জন্য সবচেয়ে নতুন অভিজ্ঞতা আপনাদের এই মা ছেলের ভালবাসা। আগলে রাখুন এমন হীরার টুকরো সন্তানকে।"
আজ আর বাসায় যেতে মন চাইলো না । ছেলেকে নিয়ে বসলাম এক রেস্টুরেন্টে। চোখ আটকে যাচ্ছিল উপহারের বাক্সের দিকে। বাসা অবধি অপেক্ষা না করে রেপিং পেপার খুলে উপহার দেখে চমকে উঠলাম। এক বক্স কাঁচের চুড়ি। আর একপাতা নীল টিপ।
আমি দীপ্তকে বললাম, "হ্যাঁ রে তুই এত টাকা পেলি কই? কিছু কিনে খাসনি এতদিন? "
দীপ্ত বলল, "তুমি টিফিন তো তৈরি করে দাও । মাঝেমাঝে টাকা দিলে অল্প কিছু দিয়ে খেতাম আর ম্যাডামকে দিতাম যেন জমা রাখতে পারেন।"
আমি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখছি। বললাম ",এসবের কি দরকার ছিল রে?আর এই উপহারের বুদ্ধি তোর মাথায় কি করে এলো?"
দীপ্ত ব্যাগ থেকে একটি ছবি বের করে দিল। হাতে নিয়ে দেখি বিয়ের আগের একটি ছবি। মনে পরে গেল কলেজের এক অনুষ্ঠানে নীল শা়ড়ি আর দুই হাত ভর্তি নীল চু়ড়িতে সেজেছিলাম আমি।খোপায় ছিল দুটো গোলাপ,কপালে নীল টিপ। খুব হাস্যজ্জ্বল একটি ছবি।অতিরিক্ত কোন অলংকার না থাকলেও মুখের ছিটকে পরা হাসিটি ছবিটিকে অন্য এক মুল্যায়ন দিচ্ছে।পুরোনো এলবাম একদিন দীপ্তকে দেখাতেই ও ছবিটা নিজের কাছে রাখতে চাইলো।
আমি ছবি দেখে বললাম , "মায়ের পছন্দ তুই এত ছোট হলেও বুঝলি কি করে?"
দীপ্তের মুখ বুকের সাথে মিশে আছে।পিঠের অংশ ফুলে ফুলে উঠছে। ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে ও।আমি কাছে গিয়ে বসে বললাম,
"কাঁদছিস কেনো রে?"
দীপ্ত বলল, "মা তোমাকে কেউ ভালবাসেনা তাই না?"
আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেল। দীপ্তর মাথাটি বুকের কাছে জাপটে ধরে বললাম,
" কে বলেছে তোকে এসব কথা?সবাই বড্ড ভালবাসে আমাকে। বড়রা একটু তর্ক করেই। তাই বলে এসব ভাবতে আছে।"
দীপ্ত মাথা নিচু করে বলল, "তাহলে তুমি সাজো না কেনো আগের মত ?হাসো না কেন কখনো?"
এবার যেন আমি দমে গেলাম। সত্যিইতো কতদিন যে সাজিনি তা মনে পরে না। হাসতেও যে ভুলে গিয়েছি তা আজ ছেলের কথা শুনে উপলব্ধি করলাম।
দীপ্ত বলল," আমি তোমায় অনেক ভালবাসি মা।তুমি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মা। আমি জানি এই ছবির মত সাজলেই এভাবে হাসি খুশি থাকবে তুমি। সাজবে না মা?আমার এমন একটা হাসিখুশি মা চাই।ঠিক এমনি।"
চোখ থেকে অনেকদিন পর সুখের ধারা গরিয়ে পরতে লাগলো। দুই হাত ভর্তি চুড়ি পরে নিলাম,দিলাম কপালে টিপ,খোঁপায় গুজে নিলাম গোলাপ। চোখের অশ্রু ছাপিয়ে জোরে জোরে হাসছি আমি । হাসছে আমার সন্তান।
কিসের দুঃখ আমার । সংসারে কিসের ভয়।কারও প্রতি নেই কোন অভিযোগ।সব উপেক্ষা,অপমান,ক্লান্তি এক নিমিষে পালিয়ে গেল।আজ যে নতুন করে সংসারকে ভালবেসে ফেললাম আমি।
এই সংসার ,এই কষ্ট, এত অভিযোগ ছাপিয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ জয়ী মা রূপে আজ ফিরে পেলাম আমি। হয়তো সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ হতেই এক যাদুকরী শক্তির প্রভাবে সব কষ্ট ,সব অপমান হাসি মুখে মেনে নেওয়ার নামই মা।।সংসারটাইতো প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম দেয় এমন শ্রেষ্ঠ মায়েদের।
দিন শেষে নিজেকে নতুনভাবে ফিরে পেয়ে বিজয়ের হাসি হেসে রওনা দিলাম নিজের নীড়ে। আজ থেকে যে সন্তানের চোখে নিজেকে দেখতে হবে আমায়। তবেই সংসারকে সুখের আলয়ে গড়ে নিতে কষ্ট হবে না একদম। সংসার হবে শান্তির নীড়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

♥নগর বাউল জেমস্ (গুরু)-র সকল গানের তালিকা James All Songs List

 ♥নগর বাউল জেমস্ (গুরু)-র সকল গানের তালিকা:   প্রথম অ্যালবাম: স্টেশন রোড  ১. স্টেশন রোড  ২. ঝর্না থেকে নদী  ৩. একদিন ছিল উচ্ছ্বল নদী  ৪. আমায় যেতে দাও  ৫. আগের জনমে  ৬. আর নয় যুদ্ধ  ৭. যদি এমন হতো  ৮. সত্যের সুন্দর  ৯. দুঃখ কেন করো   দ্বিতীয় অ্যালবাম: অনন্যা  ১.রিকশাওয়ালা  ২. ফেরারি  ৩. দুরন্ত মেয়ে  ৪. অনন্যা  ৫. রংবাজ  ৬. রাজনীতি  ৭. পলাতক  ৮. রাতের ট্রেন  ৯. হৃদয়ের দাবিতে  ১০. টেলিফোন  ১১. তুমি জান   তৃতীয় অ্যালবাম: জেল থেকে বলছি  ১. জেল থেকে বলছি  ২. নীল আকাশ  ৩. ইচ্ছের পালক  ৪. ভাবনা  ৫. জোসি প্রেম  ৬. আমার ভালবাসা  ৭. হৃদয়ের একলা প্রান্তরে  ৮. পেশাদার খুনি  ৯. ঝড়ের রাতে  ১০. ঢাকার প্রেম  ১১. তোমাকে খুঁজি  ১২. প্রাণের শহর   চতুর্থ অ্যালবাম: পালাবে কোথায়  ১. পালাবে কোথায়  ২. প্রিয় আকাশি  ৩. নাযায়েজ  ৪. পূর্ণিমা নৃত্য  ৫. হেরেমের বন্দিনী  ৬....
  জিনিসপত্রের দাম কেনো বাড়ছে জানতে চান? আসুন একটু জেনে নেয়া যাক....মুদ্রাস্ফীতির সাথে খেলাপী ঋণ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। প্রথেমেই বুঝতে হবে মুদ্রাস্ফীতি জিনিস টা আসলে কি? খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। মুদ্রাস্ফীতিঃ কোন দেশে সর্বোপরি যতটুকু সম্পদ আছে তার মূল্য ওই দেশের বর্তমানের মোট মুদ্রামাণের(টাকা) সমান। মনে করুন, বাংলাদেশে সর্বমোট ১৫ টাকা আছে এবং এই দেশের সম্পদ বলতে সাকুল্যে আছে ৫ টি কমলা। আর কিছুই নেই। যেহেতু দেশের মোট সম্পদের মূল্য মোট মুদ্রামানের সমান, সেহেতু এই ৫ টি কমলার মূল্য ১৫ টাকা। অর্থাৎ, প্রতিটি কমলার মূল্য ৩ টাকা। এখন যদি আরো ৫ টাকা ছাপানো হয়, তাহলে মোট মুদ্রামান হয়ে যাবে ১৫+৫ = ২০ টাকা। কমলা কিন্তু বাড়েনি। তারমানে এখন[নতুন করে ৫ টাকা ছাপানোর পর] ৫ টি কমলার মোট মূল্য হয়ে গেল ২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি কমলার বর্তমান মূল্য ৪ টাকা। এই যে সম্পদ না বাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে কমলার দাম ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা হয়ে গেল, এইটাই সহজ ভাষায় "মুদ্রাস্ফীতি"। একই পণ্য আগের থেকে বেশি দামে ক্রয় করা মানেই মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি "কোন দেশের সম্পদের পরিমাণ ...

বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত.pdf

বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত.pdf To download this pdf simply follow instructions if not then use vpn to open MediaFire. Some isp just blocked this website mistakenly. Author: Jsny